বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
পর্যটন খাতে নতুন ধারণার নাম  জয়রামপুর পর্যটন গ্রাম
পর্যটন খাতে নতুন ধারণার নাম জয়রামপুর পর্যটন গ্রাম

পর্যটন খাতে নতুন ধারণার নাম জয়রামপুর পর্যটন গ্রাম

মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার 
প্রকাশের সময় : April 07, 2022 | পর্যটন

পর্যটন গ্রাম হলো কোন গ্রামকে পর্যটনের মাধ্যমে রূপান্তর এর উদ্দেশ্যে পর্যটন অনুগন্তব্য হিসেবে তৈরি করা। নগরের শিল্পাঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ঘনবসতির বিপরীতে গ্রামে সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পর্যটন গ্রাম বা এগ্রো ট্যুরিজম অসামান্য গুরুত্ব বহন করে। পর্যটন গ্রাম সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামের নির্মল আলো বাতাসের মধ্যেই পণ্যের বহুমুখীকরণসহ নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গ্রামের মানুষকে গ্রামে রেখে এ ধরণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যটনসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সেবা ও বহুধরণের নিত্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে ব্যাপক ভূমিকা রাখার জন্য পর্যটন গ্রামের গুরুত্ব অপরিহার্য। ভারতের অরুণাচল ও সিকিমে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেকগুলি পর্যটন গ্রাম গড়ে উঠেছে। এছাড়া নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে পর্যটন গ্রামের ধারণা আরো আগের।

ইট-পাথরের শহরের খুপরি ঘরে সবই কৃত্রিম। অথচ ছায়ায় ঘেরা মায়ায় ভরা গ্রাম, আঁকাবাঁকা বয়ে চলা নদী-খাল, সবুজ শ্যামল মাঠ সবকিছুই প্রাকৃতিক। বাংলাদেশের গ্রামগুলো ছবির মতো সাজানো আর গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর অতিথিপরায়ণতা গ্রামীণ সৌন্দর্যকে হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। অন্ধকার রাতে জোনাকি পোকার আলো গ্রামগুলোকে করে তোলে চোখ ঝাঁঝালো। গ্রীষ্ফ্মকালের রসালো ফলের উৎসব সবার মন ভরিয়ে দেয়। নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় গ্রামগুলোতে শুরু হয় নবান্ন অনুষ্ঠান উদযাপনের আমেজ। এসব মিলিয়ে বাংলাদেশের গ্রামগুলো হতে পারে পর্যটন আকর্ষণের অপার সম্ভাবনা। এমন পর্যটনের মাধ্যমে বাংলার আবহমান সংষ্কৃতিকে যেমন ধরে রাখা যায় তেমনই বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায় বাংলার মানুষের জীবনধারা।


বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে যশোরের বাগারপাড়া উপজেলার জয়রামপুর পর্যটন গ্রাম আবার সেজে উঠে বিভিন্ন উৎসবে। তখন গ্রামবাসী এবং বাইরে থেকে আসা অতিথি এবং পর্যটকদের মিলনমেলায় পরিণত হয় এ গ্রাম। লাইফ স্টাইল ট্যুরিজমের অংশ হিসেবে গ্রামের কুমার, কারিগর, কৃষকসহ নানা পেশাজীবীর বাড়িতে এবং তাদের কর্মক্ষেত্র ঘুরে ঘুরে দেখার মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা পর্যটকরা অর্জন করেন। সারাদিন গ্রামীণ খেলাধুলা, বন-বাদারে চড়ুইভাতি, মাঠে নদীতে ছুটাছুটি আর ঝাঁপিয়ে পড়ার যে অবারিত মজা সেখানে চলে; তা নিতে চাইলে দেশের প্রথম পর্যটন গ্রাম জয়রামপুর আপনাকে আসতেই হবে! ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন চারিদিকে রাত্র নেমে আসে, একটানা ঝিঝি পোকার ডাক যেন এক মায়াবী পরিবেশে নিয়ে যায় অন্য কোন জগতে। 
শীত আগমনের শুরুতেই সোলো ক্যাম্পিং বা একক ভাবে বনে জংগলে তাবু বাস, প্রকৃতি হতে খাদ্য- পানীয় সংগ্রহ করে টিকে থাকার এক অন্যরকম অনুভূতির সূচনা হয় সেখানে। প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্যে নির্জন বাস, এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিতে চাইলে একদিকে নদী, একদিকে প্রাচীন বাওড়, নদী আর বাঁওড়ের মধ্যখানে ফসলের মাঠ, ফলের বাগান বসত বাড়ি ধানের ক্ষেত, এসবের সাথেই পুরো গ্রামটাই যথেষ্ট নির্জন বন জংগল বেষ্টিত। এখনো এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে আছে শিয়াল, খাটাশ , গুইসাপ, বেজি, চিকা, কাঠবেড়ালি, বহু প্রজাতির পাখি আর উভচর- সরীসৃপ। এমন পরিবেশ সোলো ক্যাম্পিংয়ের আদরশ স্থান হতে পারে বৈকি। 
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা প্রধান তিনটি মৌসুমের বিচিত্রতা নিয়ে সাজবে জয়রামপুর এগ্রো ট্যুরিজম ভিলেজ সারা বছর, তার জন্য চাই একদল প্রশিক্ষিত গাইড, এবং হোম স্টে করার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে গ্রামের বাসিন্দাগনের মধ্যে হতে আগ্রহী  কয়েকজনের বাড়ি। তবে এর জন্য ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণ এবং প্রস্তুতির অনেকাংশ সম্পন্ন হয়েছে সেখানে। ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম পর্যটন গ্রাম "জয়রামপুর এগ্রো ট্যুরিজম ভিলেজ" এর তরুণ-তরুণীদের কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটন, হসপিটালিটি, ট্যুর অপারেশন, ট্যুর গাইডিং এর প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়। অতিথি ট্রেইনার হিসাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন ঈড়হাবহঃরড়হধষ ঞৎধরহবৎ ড়হ ইঁংরহবংং পড়সসঁহরপধঃরড়হ সহ দেশের বিভিন্ন হসপিটালিটি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষকবৃন্দ। ভাষাগত জটিলতা সমাধানে লক্ষ্যে গাইডদের জন্য মোবাইলে 'ভাষা ট্রান্সলেশন এপস' এর ব্যবহার শিখানো হয়। 
অবস্থান ও অবস্থাঃ  
ভৈরব নদ সংলগ্ন এই গ্রামের পার্শ্বেই রয়েছে একটি প্রাচীন বাওর ও রাধানগর রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। এই গ্রাম থেকে মাত্র ২.৫ ঘন্টায় নৌপথে বা সড়কপথে ভ্রমণ করা যাবে সুন্দরবনের করমজল ও ডাংমারি। সড়কপথে মাত্র ৪৫ মিনিটে যাওয়া যাবে মাইকেল মধুসুদন দত্ত ৩০ মিনিটে এস এম সুলতানের বাড়িতে। ৩০ মিনিটের ড্রাইভে পৌঁছে যাওয়া যাবে যশোর বিমান বন্দর। মাত্র ১ ঘণ্টায় দক্ষিন এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল এবং ২ ঘণ্টায় পৌঁছান যাবে মংলা সমুদ্রবন্দরে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী প্রতাপাদিত্যের চাচড়া, মুড়ুলী হাজী মুহাম্মদ মুহাসিন জমিদারবাড়ি, অভয়নগর এগার শিব মন্দির, ২হাজার বছর প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ভরত রাজার দেওল, অষ্টম শতাব্দীর ডালিঝরা বুদ্ধবিহার, মুঘল আমলের মির্জানগর হাম্মামখানা, গাজিকালু-চম্পাবতীর মাজার, বাংলাদেশের একমাত্র ফুলের হাট গদখালি, বীরশ্রেষ্ঠ নুর মুহাম্মদ শেখের সমাধি, দেশের ব্যাস্ততম নোওয়াপাড়া নদীবন্দর, ব্রিটিশ ভারতের সর্বপ্রাচীন কালেক্টরেট ভবন, শেরশাহ সুরী নির্মিত গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোডের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি মাত্র ১৫ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যেই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা অনায়াসে পৌঁছে যাবে।
 হোমস্টে (গ্রামবাসীর কারো বাড়িতে রাত্র যাপন এর ব্যাবস্থা), গ্রামীণ বাংলো মাটির ঘর কুরে ঘর এবং ট্রি হাউজ করা হচ্ছে জয়রাপুর গ্রমে। নৌকায় বাস করার সুযোগ রয়েছে এখানে। দেশের যে কোন প্রান্ত হতেই এখানে আসা মোটামুটি সহজ। যশোর শহর হতে মাত্র ২৫-৩০ মিনিটের দূরত্বে এই গ্রামের অবস্থান। আর পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হলে ঢাকা হতে মাত্র ৩ ঘণ্টায় সড়ক পথে, ২.৫০ মিনিটে রেলপথে এখানে আসা যাবে। উল্লেখ্য, পর্যটকগণ কেউ চাইলে বিমানে ঢাকা হতে মাত্র ৩০ মিনিটে যশোর পৌঁছে এখানে আসতে পারেন। এছাড়াও নৌপথে ঢাকার সদরঘাট হতে বেশ কিছু সরকারী সাধারন বা বিলাসবহুল নৌযানে করে খুলনা পৌঁছে সেখান হতে সড়ক নৌ বা রেল পথে জয়রামপুর পর্যটন গ্রামে আসতে পারেন।


  দেশবিদেশের পর্যটকগনের জন্য থাকা-খাওয়া দর্শনীয়স্থান ভ্রমণ সরাসরি নৌকা চালানো মাছ ধরা বা কৃষিকাজে অংশগ্রহণের ব্যবস্থাসহ সব ঋতুর উপযোগী করে গ্রাম্য নির্মল বিনোদনের জন্য সার্বিক ব্যবস্থা আছে ‘জয়রামপুর কৃষি পর্যটন গ্রামে। কারুপল্লি, জৈব পদ্ধতিতে ধানচাল, সবজি, দেশি-বিদেশি ফল, মাছ, দেশি হাঁসমুরগি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ইত্যাদি উৎপাদন ও বিপণনের উপর প্রশিক্ষণ ও ব্যাবস্থাপনার কাজ শুরু করেছে ‘মিরাকি কৃষি পরিবার’ নামের একটি বেসরকারী কৃষিভিত্তিক সমবায় সমিতি। 
দেশের গ্রামগুলোকে বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে একমাত্র উপায় হলো পর্যটন গ্রাম তৈরি । এতে গ্রামীণ পর্যায়ে মানসম্মত পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে মধ্যস্থতাকারীদের হস্তক্ষেপ ব্যাতিরেকে সরাসরি পর্যটকদের কাছে বিক্রয় করা সম্ভব হবে। তরুণ পর্যটকরা গ্রামের মানুষের জীবনধারা দেখে জীবন গঠনে নতুন শিক্ষা গ্রহণ করবে। নগর ও গ্রামের মধ্যে তৈরি হবে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক। গ্রামের মানুষের শহরমুখিতা কমবে এবং সর্বোপরি সামাজিক বৈষম্য দূর হবে। এছাড়াও করোনাকালে সারা পৃথিবীর যে পরিবর্তন আসছে তাতে করে প্রত্যক্ষ গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটনকে ঢেলে সাজানোর কোন বিকল্প নাই মর্মে সারা পৃথিবীর পর্যটন বিশেষজ্ঞগণ একমত পোষণ করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের যে ভয়াবহ প্রভাব বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ এর সাথে আলোচিত হচ্ছে, সেই ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আংশিক ভাবে হলেও মুক্তি দিতে পারে গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক পর্যটন। পাহাড়, নদী, জলাশয়, প্রকৃতিকে নিজের রুপে রেখে গ্রামীণ বা কৃষিভিত্তিক পর্যটনে যে কেউই নিতে পারে জীবনের স্বাদ ।