শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
গতিশীল জীবনযাত্রার পাশাপাশি লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ
আজাহারুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক - এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক লিমিটেড, (লেটস গো রাইড শেয়ারিং)

গতিশীল জীবনযাত্রার পাশাপাশি লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ

প্রকাশের সময় : June 23, 2022 | গণযোগাযোগ ও গণতন্ত্র

আজাহারুল ইসলাম একজন চিন্তাশীল উদ্ভাবনী উদ্যোক্তা। তিনি এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক লিমিটেড (লেট’স গো রাইড শেয়ারিং) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। রাইড শেয়ারিং বর্তমান পৃথিবীতে একটি ব্যপক সম্ভাবনাময় খাত। এটি মানুষের জীবনযাত্রাকে যেমন সহজ করেছে একই সঙ্গে বেকারত্ব দূরিকরণেও সন্তোষজনক হারে ভূমিকা রাখছে। লেট’স গো রাইড শেয়ারিং এর স্বপ্নযাত্রা ২০১৮ সালে দেশের অন্যতম দূরদর্শী উদ্যোক্তা ড. মাহফুজুর রহমানের হাত ধরে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেসরকারী স্যাটেলাইট টেলিভিশন প্রতিষ্ঠায়ও মাহফুজুর রহমানের চিন্তাশীলতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। করোনা মহামারিতে কিছুটা থমকে গেলেও মাহফুজুর রহমানের গতিশীল চিন্তা ও আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে পরিবহন সেবা সহজকরণ ও বেকারত্ব দূরিকরণে লেট’স গো টিম বিরামহীন ভাবে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের রাইড শেয়ারিং এর বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিষিদ্ধ’র মুখোমুখি হয়েছেন আজহারুল ইসলাম।

প্রতিষিদ্ধ: বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং এর ভবিষৎ কেমন দেখছেন?

আজাহারুল ইসলাম: রাইড শেয়ারিং যত বাড়বে, ততই ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা ভালো হবে, নিজের পছন্দ মতো কম ভাড়ায় অ্যাপে রাইড শেয়ারিং করা যাবে, সেটা হতে হবে নিয়ন্ত্রিত কেন বলছি একথা কারণ নিয়ন্ত্রিত না হলে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিও বাড়বে। মাত্র এক দশক আগেও কোথাও ‍যাওয়ার জন্য ভাড়ার বিনিময়ে গণপরিবহনের একমাত্র বিকল্প নছিল ট্যাক্সি বা রেন্ট-এ-কার। আমাদের দেশে মাত্র কয়েক বছর আগেও পরিস্থিতি ছিল ঠিক একইরকম। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে ২০১১ সালে যখন প্রথম রাইড শেয়ারিং সেবা শুরু হয়। সারা বিশ্বের মতো এই ব্যবসা পৌঁছে যায় বাংলাদেশেও। বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং সেবা শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত, দেশী-বিদেশী মিলিয়ে ২০ টির বেশি প্রতিষ্ঠান এই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাইড শেয়ারিংয়ের ভবিষ্যৎ এবং অর্থনীতি বেশ আলোচনায় এসেছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠান লিফট এবং উবারের নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে প্রবেশ করার কারণে বিনিয়োগকারীসহ সাধারন মানুষের মধ্যে এই ব্যবসার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

প্রতিষিদ্ধ: রাইড শেয়ারিং এর ইতিবাচক বিষয় গুলো সম্পর্কে বলবেন?

আজাহারুল ইসলাম: আধুনিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থায় ব্যবহারকারী ও ড্রাইভার উভয় পক্ষের সিকিউরিটি থাকে। অল্প সময়ে কম খরচে যে কোনো ধরনের রাইড পাওয়া যায়। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমশই অগ্রগতি অর্জনের পথে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলাফল আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এগিয়ে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার গত এক দশকে ৫-এর ঘর থেকে ৮-এর কাছাকাছি উঠে এসেছে। পাশাপাশি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার জন্য প্রশংসিত হচ্ছে বর্তমান সরকার। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করা হয় তাতে করে প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্যের নিম্নে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা ও তাদের প্রকৃত আয় সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। এতে করে অর্থনীতিতে তীব্র আয়বৈষম্য দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর হিসাবে গত নভেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে। এই তথ্যমতে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে তীব্র আয়বৈষম্য অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই রাইড শেয়ারিং যেমন কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখবে সাথে সাথে স্বল্প আয়ের মানুষদের আরামদায়ক পরিবহণ ব্যবস্থায় সহায়তা করবে।
 

প্রতিষিদ্ধ: রাইড শেয়ারিং এ বর্তমানে কত সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আজাহারুল ইসলাম: এই রাইড শেয়ারিং অ্যাপসে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসন্থান হয়েছে, সামনে আরোও বাড়বে। বিশ্বের বহু দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু করে ব্যক্তিগত মোটরযান ভাড়ায় যাত্রীবহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। আমাদের দেশে রাইড শেয়ারিং সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালের মে মাসে। ১৮ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এই শহরে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে, বেকার সমস্যা সমাধানে ও দেশের অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে এই সেবাখাত অবদান রাখতে শুরু করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দশম সংসদের শেষ অধিবেশনে সমাপনী বক্তব্যে বলেছেন, “অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবাখাত থেকে এক লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে”।

বর্তমানে এই সেবাখাত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরে প্রায় ৩ হাজার স্নাতকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেকারত্ব দূরীকরণ ও তাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

প্রতিষিদ্ধ: রাইড শেয়ারিং বর্তমানে আমাদের জীবনে কত শতাংশ প্রয়োজনীয়তা কে স্পর্শ করেছে বলে আপনি মনে করেন?

আজাহারুল ইসলাম: দৈনন্দিন জীবনে যাতায়াত ব্যবস্তার সমাধান করেছে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ্স, বলতে গেলে নিত্যদিনের প্রয়োজয়ীয়তাকে আরও আনন্দময় করে তুলেছে। বর্তমান রাইড শেয়ারিং মার্কেট এক বছরে ২২শ’ কোটি টাকার বাজার ও পুরো ট্রান্সপোর্টেশন সেক্টরে ২৩ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে। যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.২ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এক সমীক্ষা মতে ঢাকায় গড় গতি ঘণ্টায় ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার। যা প্রাইভেট কারে ১২ কি.মি. এবং মোটরসাইকেলে ১৬ কি.মি.। ১ কোটি ৮০ লাখ জনগোষ্ঠীর এই শহরে রাইড শেয়ারিং সেবা কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক মনে করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে একজন মানুষও দারিদ্র্যের নিচে বসবাস করবে না এবং একজন মানুষও না খেয়ে থাকবে না! যেহেতু এমডিজি ছিল সহায়তা নির্ভর সেক্ষেত্রে তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সহজ ছিল। কিন্তু এসডিজি যেহেতু নিজস্ব অর্থায়নে করতে হবে সেহেতু সরকার ও প্রাইভেট সেক্টরের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। নতুবা এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রতিষিদ্ধ: রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান গুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নীতিমালাগুলোর বর্তমানে প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহক উভয়ের জন্য কেমন সহায়ক বলে আপনি মনে করেন?

আজাহারুল ইসলাম: এখনও পর্যন্ত কোনো এসোসিয়েশন তৈরি হয় নেই, বিআরটিএ এর কিছু ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান এর নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে, ২০১৭ এর নীতিমালা তৌরি করেছেন। রাইড শেয়ারিং সারা পৃথিবীতেই নতুন ধরনের একটি ব্যবসা। স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যবসা নিয়ে খুব বেশি পূর্বাভাস দেওয়া সহজ বিষয় নয়। তারই সাথে এ বিষয়ে গবেষণার সংখ্যাও খুব কম। বাজার নিয়ে হয়তো প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রাইড শেয়ারিংয়ের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা এখনও হাতেগোনা। তাই এই বিষয়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়ই বটে। কোম্পানিগুলোর ব্যবসা, সার্বিক অর্থনীতিতে রাইড শেয়ারিং এর অবদান ইত্যাদি বিষয়ের চেয়ে মনে হয় চালক ও যাত্রীদের ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি বা ব্যষ্টিক অর্থনীতির বিষয়টিই বেশি মানুষকে ঘোরপাক খাওয়ায়। এ বিষয়টি প্রায় সন্দেহাতীত যে, যাত্রীদের জন্য রাইড শেয়ারিং সেবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাভজনক। প্রথমেই চলে আসে, রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে যাত্রী, ট্যাক্সি বা সেরকম সেবার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে পরিবহন সেবা নিতে পারে। তারই সাথে যোগ হয়ে যায়, বাসায় বসে অ্যাপের মাধ্যমে বাহন খুঁজে পাওয়ার সুবিধা। এর ফলে যাত্রীর পরিবহন খোঁজার সময় ও শ্রম, দুটোই বাঁচে।

প্রতিষিদ্ধ:  রাইড শেয়ারিং ও সড়কের যানজট একে অপরের সঙ্গে কেমন পরিপূরক?

 আজাহারুল ইসলাম: দুইটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। রাইড শেয়ারিং হওয়ার কারণেই বর্তমানে পাবলিক পরিবহনের ঠেলা ঠেলি থেকে অনেক অংশেই মুক্তি পাচ্ছে। আর যে গাড়ি গুলো অবসরে বসে থাকতো এই গাড়ি গুলোই রাইড শেয়ারিং এ চলছে। প্রচুর বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় অ্যাপভিত্তিক পরিবহন এই সেবা খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার যদি সহায়তা করে এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ খাতের বিকাশের জন্য যদি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়ন করে তাহলে বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে এসডিজির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে পাশাপাশি তীব্র আয়বৈষম্য কমে অর্থনীতি বিকাশমান হবে। আজকের এই ডিজিটাল বাংলাদেশে যানজট নিরসন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস ছিল সময়ের দাবি। মেট্রোরেল (এমআরটি), বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পাতাল রেল, সড়ক বহুমুখীকরণসহ বর্তমানে দেশে অবকাঠামোগত যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছে সেখানে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্যতার বিচারে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস এক বিশাল সাফল্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন দরকার একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা যা এই খাতে টেকসই উন্নয়ন এনে দেবে।

প্রতিষিদ্ধ: আমাদের মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজাহারুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।