শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ২৪০ দপ্তরীর বিরামহীন ডিউটি
মোঃ মামুনুর রশিদ মিঠু

হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ২৪০ দপ্তরীর বিরামহীন ডিউটি

মোঃ মামুনুর রশিদ মিঠু
প্রকাশের সময় : August 11, 2022 | রংপুর

শিক্ষা আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই, আউটসোসিং শিক্ষা নীতিমালা মোতাবেক লালমনিরহাটের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রাপ্ত দপ্তরী কাম প্রহরীদের সরকারি ছুটি প্রাপ্যতার কথা থাকলেও তারা কোন ছুটি পাচ্ছেন না। ফলে লালমনিরহাট জেলায় কর্মরত ২৪০ দপ্তরী কাম প্রহরী বিরামহীন  ২৪ ঘন্টাই ডিউটি করছেন। অতিরিক্ত কর্মভারে ক্লান্ত দপ্তরী কাম প্রহরীদের দায়িত্ব ২৪ ঘন্টা নয়, শুধুমাত্র বিদ্যালয় টাইম (খোলা ও বন্ধ) পর্যন্ত  মহামান্য হাইকোর্ট দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিলেও এ জেলায় দপ্তরী কাম প্রহরীদের ডিউটির ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। মহামান্য হাইকোর্টের রায় আশপাশের জেলায় বাস্তবায়ন হলেও এজেলায় তা বাস্তবায়নের কোন সুখবর এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ফলে নিরুপায় হয়ে সদর উপজেলা দপ্তরী কাম প্রহরী সমিতির পক্ষ থেকে মহামান্য হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের লক্ষে বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আউটসোর্সিং নীতিমালা এবং ২০১২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আউটসোর্সিং নীতিমালায় নিয়োগ প্রাপ্ত সারাদেশের ন্যায় লালমনিরহাটে ২৪০ জনকে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী কাম প্রহরী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে এ জেলার সদর উপজেলায় ৭২ জন, আদিতমারী ২৫ জন, কালীগঞ্জে ৫৭ জন, হাতীবান্ধায় ৩৪ জন ও পাটগ্রাম উপজেলায় ৫২ জন। এ সব দপ্তরী কাম প্রহরীরা নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই ২৪ ঘন্টাই তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সততা এবং নিষ্টার সাথে পালন করে আসছেন বলে জানিয়েছেন তাদের সংগঠনের নেতারা। 
ওই সব দপ্তরী কাম প্রহরীরা প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টায় বিদ্যালয়ের গেট খোলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের ডিউটি। তারপর শুরু হয় বিদ্যালয়ের অফিস ও শ্রেণী কক্ষ ঝারা মুছাসহ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা। সকাল সাড়ে ৯টা বাজতে না বাজতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখেরিত হয়ে উঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গন। ১০টা বাজতে বাজতে দিতে হয় জাতীয় সঙ্গীতের ঘন্টা। এরপর সকল শিক্ষার্থীকে মাঠে সোজা লাইনে দাঁড় করানো, জাতীয় সঙ্গীত শেষে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ক্লাসে পৌঁছে দেয়া, ক্লাস শুরু হলে ক্লাসে ক্লাসে পৌঁছে দিতে হয় চক ও ডাস্টার, সেই সাথে শিখনের সময় প্রধান শিক্ষকসহ সকল শিক্ষকদের হাতের কাজে সহযোগিতা করা। এভাবে অর্ধেকদিন পেরিয়ে বিরতি হলেই দুপুরের খাবার টুকুও বিদ্যালয়ে খেয়ে আবার শিক্ষকদের সহযোগিতা করতে করতে ৪/৫ টা বাজলেই বিদ্যালয় দিতে হয় ছুটির ঘন্টা। মাঝের ঘন্টাগুলো তো রয়েছেই। ছুটি শেষে সবাই চলে গেলেও দপ্তরী কাম প্রহরীরা আর বাড়ি যেতে পারে না। শুধুমাত্র রাতের খাবার টুকু বাড়িতে খেয়ে আবারও রাতে বিদ্যালয় পাহাড়ার কাজে যুক্ত হন। কারণ বিদ্যালয়ের একটি ডাস্টার হারালেও জবাব দিতে হয় দপ্তরী কাম প্রহরীকে। এক কথায় তারা ২৪ ঘন্টাই শ্রমিক। মাস শেষে বেতন পেতে নানান বিড়ম্বনা পোহাতে হয় তাদের। দপ্তরী কাম প্রহরীর এক মাসের বেতন পেতে পেতে পরের মাসের ১৫/২০ তারিখ লেগে যায়। সঠিক সময় বেতন না পেলেও বছরের পর বছর ধরে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন। কাজের সময় সর্বদা প্রস্তুত দপ্তরী কাম প্রহরীদের ক্ষেত্রে শ্রম ঘন্টায় নীতির কোন বালাই নেই। 
অথচ ২০১২ সালের আউটসোসিং নীতিমালায় অনুচ্ছেদ ১১/১ মোতাবেক নিয়োগ প্রাপ্ত দপ্তরী কাম প্রহরীদের সরকারি ছুটি প্রাপ্যতার কথা থাকলেও তারা কোন ছুটি পান না। সরকারী ছুটিসহ বিভিন্ন দুর্যোগে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও দপ্তরী কাম প্রহরীর কোন বন্ধ নেই। অতিরিক্ত কর্মভারে ক্লান্ত দপ্তরী কাম প্রহরী সংগঠনের নেতারা কর্মঘন্টা ও ছুটি প্রাপ্তির দাবী তুলে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রীট পিটিশন দায়ের করেন। যার রীট পিটিশন নং- ১৭০৮৩-২০১৭, তাং ১৪/০৩/১৯ইং। উক্ত রীট পিটিশনে মহামান্য হাইকোর্ট দপ্তরী কাম প্রহরীদের দায়িত্ব ২৪ ঘন্টা নয়, শুধুমাত্র বিদ্যালয় টাইম (খোলা ও বন্ধ) পর্যন্ত বলবৎ রাখাতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন। যা ইতিমধ্যেই কুড়িগ্রাম, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও দিনাজপুরসহ আশপাশের জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। শুধুমাত্র মহামান্য হাইকোর্টের রায় কার্যকরের বিষয়টি লালমনিরহাটে কেউ আমলে নিচ্ছেন না। এমন দাবী ভুক্তভোগীদের। 
মহামান্য হাইকোর্টের রায়কে অমান্য করে শিক্ষাকর্তারা মাঠ পর্যায়ে দিন/রাত শ্রম দিতে বাধ্য করাচ্ছেন দপ্তরী কাম প্রহরীদের। হাইকোর্টের ঐ রায় কার্যকরে সদর উপজেলা দপ্তরী কাম প্রহরী সমিতি ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসক, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের স্মারকলিপিসহ দফায় দফায় আবেদন করেও দপ্তরী কাম প্রহরীদের ভাগ্যে এখনো মেলেনি সুফল। 

এ বিষয়ে সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের বুড়িরদীঘি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী কাম প্রহরী ও উপজেলা দপ্তরী কাম প্রহরী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোন্নাফ জয় বলেন, আমরা ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হলেও আমারও মানুষ। আমাদের দুঃখের কথা কেউ শুনেন না। অথচ বিদ্যালয়ের সব কাজ আমাদের দিয়ে করানো হয়। এক কথায় আমরা ২৪ ঘন্টাই শ্রমিক। একজন প্রমজীবী মানুষ ৮ ঘন্টার বেশি সময় কোন কাজেই শ্রম দেন না। আমাদের কর্মঘন্টা ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্ট শুধুমাত্র বিদ্যালয় টাইম পর্যন্ত দপ্তরী কাম প্রহরী দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমরা আমাদের কর্মঘন্টার বিষয় দফায় দফায় আবেদন করেও কোন সুফল পাচ্ছি না। মাস শেষে বেতন পেতেও পোহাতে হয় নানান ভোগান্তি।
মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের নিজপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী কাম প্রহরী স্বপন কুমার রায় ও একই ইউনিয়নের মৃত্তিকা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী কাম প্রহরী মাহাবুবর রহমান বলেন একই কথা। আমাদের কথা কেউ শুনেন না। আমাদের কর্মঘন্টা মহামান্য হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। এটাই আমাদের প্রাণের দাবী ও অধিকার। দফায় দফায় আবেদন করেও আমরা কোন সুফল পাইনি। শিক্ষকরা মাস শেষে ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে বেতন পান। আর আমরা দপ্তরী কাম প্রহরীরা জানুয়ারি মাসের বেতন ফেব্রুয়ারির ১৫/২০ তারিখ ছাড়া পাই না। আবার কোন কোন মাসে পাই না। 
সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দপ্তরী কাম প্রহরীদের স্মারকলিপি পেয়েছি। তা বাস্তবায়নের জন্য জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নিকট সুপারিশসহ পরর্বতী নির্দেশনার জন্য পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। 
দপ্তরী কাম প্রহরীদের স্মারকলিপি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম নবী বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছাড়া আমি তাদের ছুটি কার্যকর করতে পারছি না। কারণ জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আরও বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি দপ্তরী কাম প্রহরীদের কর্মঘন্টা বেঁধে নির্দেশনা দেন তাহলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।