আমি তখন সদ্য বিদায়ী ছাত্রনেতা। দুই হাজার পাঁচ সালের শেষ দিন আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নিকট সহযোগী সদস্য ফরম পূরণ করে ঢাকা মহানগর ৩৬ ওয়ার্ড উত্তরে কাজ শুরু করি। পঁচাত্তর দিনের মাথায় রোকন হয়ে ছোটখাটো বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে আসছিলাম।
ঈদের ছুটিতে যেতেই পল্টন থানার তৎকালীন আমীর এটিএম সিরাজুল হক বললেন ঈদের পরের দিন ঢাকায় ফিরতে হবে। কারণ দুইদিন পরেই সরকারের শেষ দিন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
জামায়াত বায়তুল মোকাররম উত্তর গেইটে শেষ দিবসে গণজমায়েত রেখেছে। আর বিএনপি নয়াপল্টনে তাদের কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে মিটিং রেখেছে।
এদিকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে মিটিং রেখেছে আওয়ামী লীগ। তারা লগি বৈঠা নিয়ে সাজ সাজ উত্তেজনা পূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে। সকাল থেকেই থেমে থেমে বোমা হামলা,গুলি ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করে জামায়াতের মিটিং ছত্রভঙ্গ করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়। কমিটেড জামায়াতের নেতাকর্মীরা কোনভাবেই ছাড় দেয়নি বিধায় মুজাহিদসহ বেশ কয়েকজন শাহাদাত বরণ করে। আহত হয় অনেকেই।
আমার গ্রুপের দায়িত্ব ছিলো বিজয় নগর মুসলিম সুইটসের বিপরীত গলিতে। ছাত্রলীগ যুবলীগ সচিবালয় ও সেগুনবাগিচা পূর্ণ দখলে নিয়ে পূর্ব পাশে জামায়াত বিএনপির মিটিং বানচালের জন্য হেন চেষ্টা চালিয়েছে।
জামায়াত প্রাণপণ চেষ্টা করে নেতা কর্মীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়েছিল সেদিন। বিএনপির কর্মসূচি সংক্ষেপে শেষ করে ফেললেও অনেক নেতাকর্মী আহত হয়েছে।
আমাদের গ্রুপ ইটপাটকেল নিক্ষেপের মধ্যে পড়ে গেলে আমার বুকের ডান পাশ ইটের আঘাতে কেটে যায়। নিচে থেকে তাদের মুহুর্মুহু ইটপাটকেল এর আঘাতে আমাদের ক্ষতি হবে দেখে আমরা ইটপাটকেল সহ একটি ভবনের দোতলার ছাদে অবস্থান নিই এবং উপর থেকে ইট নিক্ষেপ করাতে তারা ভয় পেয়ে আর আমাদের গলির ভিতর আসার সাহস পায়নি।
এভাবে থেমে থেমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এবং রাতে যার যেমন বাসায় চলে যায়। ঐদিন পল্টনের আকাশ বাতাস ভারী হয়েছিল আওয়ামী হায়েনাদের অত্যাচারে।
পুলিশকে সারিবদ্ধ হয়ে সেদিন দায়িত্ব হস্তান্তরের কাজে রাস্তায় দেখা গেলেও এই হত্যাকাণ্ডে কোন ধরনের ভূমিকা রাখতে দেখিনি।
এরপর থেকে প্রতিবছর ২৮ অক্টোবর লগিবৈঠার নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাবেশ করলেও সর্বশেষ ২৩ সালের ২৮ অক্টোবর জামায়াত মিটিং ডাকে শাপলা চত্বরে এবং বিএনপি ডাকে তাও তাদের অফিসের সামনে। জামায়াত ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে উক্ত সমাবেশ সফল করলেও বিএনপির অনেক উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও পুলিশের টিয়ার সেল নিক্ষেপে মিটিং কোন কর্মসূচি ছাড়াই শেষ হয়ে যায়। জনাব তারেক রহমান জামায়াতের সফলতা নিয়ে সমালোচনাও করেছিলেন। বিএনপি সেদিন কোন কর্মসূচি না দিয়ে পরবর্তী ২৪ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত চুপচাপ থাকাতে আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে এবার কোন আলোচনার জন্যও আহ্বান করেনি।
আওয়ামী লীগ একচেটিয়া তাদের মত করে নির্বাচন করে নেয়। সতস্ফুর্ত ভাব ছয়মাস তারা সরকার পরিচালনা করলে শুরু হয় মেধাবীদের কোটা বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলন যে ত্রিশ দিনের একটি মাসকে টেনে ছত্রিশ দিনে রুপান্তরিত করেছে,তা কে জানতো আসলে। কোন রাজনৈতিক দল ভাবেনি এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি হবে।
আল্লাহ যতক্ষন চাইবে ততক্ষন থাকতে পারবে,আর যখন চাইবেন না,তখন হাল ছেড়ে দিতে হবে যে তা দিবালোকের মত সত্য প্রমাণিত হয়েছে পাঁচ ই আগষ্ট। শেখ হাসিনা আরো লাশ উপহার দিয়ে থাকতে চাইলেও তাতে আর কেউ রিস্ক নেয়নি। তাই তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
উনি দেশের সবাইকে রাজাকার বানিয়ে নিজেকে মুক্তিযুদ্ধা সাব্যস্ত করতে গিয়ে মারাত্মক চাপে পড়েছেন। তাই ছাত্রদের শ্লোগান ছিলো - তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার। পরে তিনি আবার আশুরার রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখিয়েছেন। এসব মিলে হিতে বিপরীত হয়েছে। কিছু বললেই তা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনা যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল সে অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন গুলো সম্পাদন করলে হয়তো আওয়ামী লীগ তিন বারের ক্ষেত্রে দুইবার সরকারে যেতো এবং একবার বিরুধীদলে থাকতো। এরুপ দেশ ছাড়ার চিত্র তো হতো না। হাজার হাজার লোক হত্যা এবং কষ্ট থেকে বেঁচে যেতো। ইতিহাস থেকে জাতি শিক্ষা নিতে পারে না যে তা আরেক মহা ইতিহাস।
লেখক:
সম্পাদক,নিউজ সিভিএম.কম
didermojumder@gmail.com