বৃহস্পতিবার, মে ১৬, ২০২৪
করোনায় যে সেক্টরটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা হলো ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি
শেখ মিজানুর রশীদ , মহা ব্যবস্থাপক- এশিয়া হেটেল অ্যান্ড রির্সোট

করোনায় যে সেক্টরটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা হলো ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি

প্রতিষিদ্ধ প্রতিবেদক
প্রকাশের সময় : February 27, 2022 | অর্থনীতি

শেখ মিজানুর রশীদ দেশের হোটেল ও হসপিটালিটি সেক্টরের একজন উচ্চ পেশাজীবী খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। বর্তমানে এশিয়া হেটেল অ্যান্ড রির্সোটের মহা ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও কর্ম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এ ব্যক্তি।

রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোর অন্যতম এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট। করোনার আগে দেশি-বিদেশি অতিথিতে পূর্ণ থাকতো হোটেলটির মোট কক্ষের ৮০ শতাংশ। আর পিক সিজনে রুম খালি পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। বেশির ভাগ কক্ষই আগাম বুকিং দিয়ে রাখতেন অতিথিরা। কিন্তু করোনার ধাক্কায় হোটেলটির ব্যবসায় ধস নেমেছে। এখন আগাম বুকিং তো নেই-ই বরং ৮০ শতাংশেরও বেশি কক্ষ খালি পড়ে আছে। বলতে গেলে বর্তমানে প্রায় অতিথিশূন্য বলেই চলে। করোনার শুরুতেই একের পর এক বাতিল হয়েছে আগাম বুকিং। সম্প্রতি মাহামারি কালীন হোটেল ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ে শেখ মিজানুর রশীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিষিদ্ধের বিশেষ প্রতিবেদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার। 


প্রতিষিদ্ধ: বর্তমানে বাংলাদেশের হোটেল ও আতিথিয়েতা খাতে কী সংকট আছে বলে আপনি মনে করেন?
শেখ মিজানুর রশীদ: অভিজাত হোটেলগুলোর ব্যবসা সাধারণত বিদেশি ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বিদেশি অতিথিদের বুকিং বাতিলের পাশাপাশি দেশীয় বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনও বন্ধ রয়েছে। ফলে তাদের ব্যবসা কমে গেছে ৭৫ শতাংশ। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন হোটেলের মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
করোনা মহামারিতে হোটেল প্রায় শূন্য পড়ে আছে হোটেলটির লবি, রেস্তোরাঁ ও  কক্ষগুলো। অতিথি আগমন ছাড়াও হোটেলের আয়ের আরেকটি বড় উৎস হলো ভেন্যু হিসেবে আন্তর্জাতিক মেলা-প্রদর্শনী আয়োজন। করোনা আতঙ্কে এসব প্রদর্শনীও বাতিল হয়েছে। 
করোনায় এই সেক্টরটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের অন্তত ৬০ শতাংশ গ্রাহক কমে গেছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠা আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা রোস্টার অনুযায়ী কাজ করছি। স্টাফদের যেন ছাঁটাই করতে না হয় সেই ব্যবস্থাও আমরা করেছি। অতিথিদের বিষয়টিও চিন্তা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা কাজ করছি। হোটেল ম্যানেজমেন্টে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিথিদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ের পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরও পরিবার আছে। সেই বিষয়গুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি তবে পার্সেল এবং হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করেছি। যাতে বাসায় থেকেও আমাদের গ্রাহকরা ফুডসহ বিভিন্ন সুবিধা পেতে পারেন।  
প্রতিষিদ্ধ: বাংলাদেশের অভিজাত হোটেলের বর্তমান বাজারের অবস্থা জানতে চাই।
শেখ মিজানুর রশীদ : নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বের ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কারণ সংক্রমণের ভয়ে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কেউ আর ভ্রমণ করছেন না। ফলে রাজধানীর হোটেলগুলোর ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তারকা হোটেলগুলোর ৯৭ শতাংশ অতিথিই বিদেশী, যারা মূলত পোশাক খাতের বিদেশী ক্রেতা এবং বিভিন্ন দূতাবাস সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। পোশাক খাতের বিদেশী ক্রেতারা মূলত চীন থেকে কাপড় কিনে বাংলাদেশ আসেন তৈরির অর্ডার দিতে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রেতারা যেহেতু চীনে যাচ্ছেন না, তাই তারা বাংলাদেশেও কম আসছেন। এরই প্রভাব পড়ছে  হোটেলগুলোর বুকিংয়ে।
বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যবসায়িক কারণে যেসব বিদেশী বাংলাদেশ ভ্রমণ করে থাকেন, তাদের বড় একটি অংশ পোশাক খাতের ক্রেতা। কারখানাগুলোয় আসন্ন গ্রীষ্মের পোশাকের অর্ডার দিতে এ সময় আসা-যাওয়া করেন তারা। কিন্তু এ বছরের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। কভিড-১৯ আতঙ্কে পাশ্চাত্যের পোশাক খাতের ক্রেতাদের আগমন এখন একেবারে তলানিতে। পোশাকের কাপড় কিনতে তারা যেমন চীনে যাচ্ছেন না, তেমনি সেলাইয়ের অর্ডার দিতে আসছেন না বাংলাদেশেও। এছাড়া বিদেশী পর্যটকদেরও অধিকাংশই এখন বাংলাদেশ ভ্রমণ বাতিল করছে।


প্রতিষিদ্ধ: বর্তমানে আপনার ব্যবসার পরিস্থিতি কেমন? আগামী ৫ বছর পর আপনার প্রতিষ্ঠানকে আপনি কোথায় দেখতে চান?
শেখ মিজানুর রশীদ:  চলতি মাসের শুরু থেকে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। যারা আসছেন, ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে ফিরে যাচ্ছেন তারাও। এ অবস্থায় হোটেলগুলোর ব্যবসা অনেকটা স্থানীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকনির্ভর হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, আমরা একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। করোনাকালে সেক্টরটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের মূল ব্যবসা হলো আন্তর্জাতিক বিজনেস ট্রাভেলারদের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু আপাত বেশির ভাগ বোর্ডার বন্ধ আছে। কিছু ফ্লাইটও বন্ধ আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টগুলো বন্ধ থাকায় বিদেশি অতিথি একদম কমে গিয়েছে। আমাদের মূল ব্যবসা হয় রুম থেকে। যার ৬০ শতাংশই ডাউন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমাদের ব্যবসা নির্ভর করছে ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ওপরে। বিশেষ করে রমজানে আমাদের ইফতার বক্সের ব্যবস্থা ছিল। এটা থেকে মোটামুটি আয় হয়েছে। কিন্তু রেস্টুরেন্টের ডাইনিং বন্ধ থাকায় বর্তমানে খুব খারাপ অবস্থায় আছি। শুধু ফুডের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাটা কঠিন। এ অবস্থায় আমরা রুম ব্যবসায় মূলত যারা প্রজেক্ট বেইজ লং স্টেইং বিদেশি অতিথিরা আছেন তাদের ওপর নির্ভর করছি। এ ছাড়া কোয়ারেন্টিন বেইজ যারা বিদেশ থেকে আসছেন যাদের ১৪ দিন থাকতে হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে আমরা বেশি ফোকাস করছি। আপাতত এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের এভাবেই চলতে হবে। সবমিলিয়ে করোনায় এই সেক্টরটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
 বাংলাদেশে হোটেল ইন্ডাস্ট্রি করপোরেট ব্যবসা এবং ট্যুরিজম সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা একটা দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা ভয়াবহ রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি। এরপরও আমরা সরকারি বিধি নিষেধের মধ্যে থেকে যতটুকু সম্ভব ব্যবসা চালু রাখার চেষ্টা করছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের সকল স্টাফ কাজ করছে। যেহেতু বর্তমানে করপোরেট ভলিউমটা কমে গেছে। কোভিডের কারণে বেশির ভাগ দেশের মানুষকে নিষেধাজ্ঞা  দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে না আসার জন্য। তবে যে দেশগুলোর ট্র্যাভেল করার অনুমতি আছে সেই দেশগুলোর ট্র্যাভেল সেকশনের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। যাতে আমরা কিছুটা হলেও এই সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারি। সহসাই করোনা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে হোটেল ইন্ডাস্ট্রি আরো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। সারাদেশে প্রায় ৬০ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। সেগুলোতে ৩০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে এ খাতে। 


প্রতিষিদ্ধ: প্রতিষ্ঠার পর থেকে আপনার ব্যবসার অর্জন গুলো বলবেন?
শেখ মিজানুর রশীদ: হসপিটালিটি সেক্টরে যারা কাজ করে তাদের মূল্যায়ন তেমন একটি আমাদের সমাজে নেই। তাছাড়া আমাদের পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাব আছে। যদিও বিষয়গুলো দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। ট্যুরিজম থেকে যে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা হলো বিবিএসের রির্পোট অনুযায়ী ৩.০২ শতাংশ। তবে প্রতিবছরই ট্যুরিজম সেক্টরে উন্নতি হচ্ছে। আমাদের বিদেশি অতিথিদের মধ্যে অধিকাংশই চীনা এবং ভারতীয় নাগরিক। তবে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আমরা যাতে আমাদের সংকটগুলো দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারি সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। দক্ষ জনবলের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তবে সেক্টরটা বড় হওয়ার কারণে মূলত জনবলের সংকট তৈরি হচ্ছে। তাই আমাদের সেক্টরের উন্নয়ন ও সংকট দুটোই সমান্তরাল ভাবে চলছে। 


প্রতিষিদ্ধ: আতিথিয়েতা শিল্পে আপনার কর্ম ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই। 
শেখ মিজানুর রশীদ: তিনি বলেন এ এশিয়ার হেটেলের শুরু আমার হাত ধরেই। তাই আমি অতি সৌভাগ্যবানদের একজন। আমাদের এ হোটেলটি ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে। এর আগে আমি ঢাকা ও কক্সবাজারে বিভিন্ন হোটেলে কর্মরত ছিলাম।  আমি সাধারণ একাডেমিক পড়াশুনা শেষ করার পর সৌদি আরবে চলে যাই হসপিটালিটি সেক্টরের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। সেখানে বিভিন্ন মেয়াদে আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এরপর মধ্যপ্রাচ্যেই বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্টে আমি কর্মজীবন শুরু করি। দীর্ঘদিন সেখানে কর্মরত থাকার পর আমি দেশে ফিরে আসি। 


পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ