রবিবার, মে ১৯, ২০২৪
দেশ ও মাটির জন্য নিবেদিত আপোসহীন কবি মোস্তফা ইকবাল 
মোস্তফা ইকবাল

দেশ ও মাটির জন্য নিবেদিত আপোসহীন কবি মোস্তফা ইকবাল 

মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার 
প্রকাশের সময় : January 31, 2022 | গণযোগাযোগ ও গণতন্ত্র

মোস্তফা ইকবাল, একজন স্বাধীনচেতা মানুষ ও কবি। ইকবাল সর্বোপরি প্রেম, দ্রোহ ও মরমী গানের সাধক। তিনি জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে মানবতার কবি। তিনি দেশ, মাটি ও বঙ্গবন্ধুর জন্য তার কাব্যময় জীবনকে উৎসর্গ করার জন্য প্রত্যয়দীপ্ত। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের বৃহৎ একটি সময়। তবুও অপশক্তির সঙ্গে কখনও আপোস করেননি। ১৯৮৮ সালে স্বৈরাচার বিরোধী কবিতা লেখার জন্য তিনি ২১ দিন করাবরণ করেছেন। এটি কোন রাজনৈতিক কারাবরণ নয়। কিশোর বয়স থেকেই দূরন্ত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন ইকবাল। সেই চেতনা থেকেই একসময় শুরু করেন গান লেখা। গানের জগতে নিজের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও তার সূসুপ্ত প্রতিভা বেশিদিন গোপন থাকেনি। তবে কোন বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে নয়,  নিজের মনে খোরাক মেটাতেই কবিতার পাশাপাশি আশির দশকের শেষ থেকে গান লেখা শুরু করেন। বেশকিছু গান গোছানো হলে নব্বই দশকের শুরুর দিকে প্রতিটি জাতীয় দিবসে নোয়াখালীর স্থানীয় শিল্পী বা শিল্পী গোষ্ঠীরা মঞ্চে তার গান গাওয়া শুরু করে। নোয়াখালীর সদর মাইজদী শহরের নিকটেই তার জন্ম। তাই নিজের ক্যারিয়ারে শুরুটা হয় নিজ মাটি থেকে। নিজের ছোটবেলা গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মোস্তফা ইকবাল। ইকবাল বলেন, রাস্তার পাশে যারা গান গেয়ে গেয়ে ওষুধ বিক্রি করত, বসে বসে তাদের গান শুনতাম। ইকবাল মনে করেন তার কবিতা ও গানের অনুসরণ এবং শিক্ষা প্রকৃতি থেকেই, প্রকৃতিই তার শিক্ষক ও অনুপ্রেরণার একমাত্র উৎস। ইকবাল বলেন, যেমন আমার একটা গান আছে, “আরে ঔ ঔ রে নিরুদ্দেশের যাত্রা, পথে জামিন নাইরে জামিন নাইরে জামিন নাইরে...; নব্বইয়ের মাঝামাঝি এই গানগুলো লিখেছি। আর আমার এখন মনে হচ্ছে এই সুরগুলো আমি রাস্তা থেকেই পেয়েছি। ২০০০ সালে একটি গান কলকাতার একটি শিল্পী গোষ্ঠীকে দিয়েছিলাম। তারা সেই গানটি অডিও অ্যালবামে রেখেছিল। 


বর্তমানে বাংলাদেশের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, স্নেহময়ী শেখ রাসেলের করুণ হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন প্রেক্ষিতে গান রচনা করেছেন। তার কয়েকটি গান ইতোমধ্যেই দেশের কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রচার করেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার এখনও ১শ গান আছে, যা কোন শিল্পী সেচ্ছায় গাইতে চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।  
মোস্তফা ইকবাল বলেন, আমি কোন পুরস্কার বা কাউকে সন্তুষ্ট করার আশায় গান বা সাহিত্য রচনা করি না। মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং স্বরণ আমার মন-প্রাণ, ধ্যান ও মননের পুরোটা জুড়েই আছে। বঙ্গবন্ধু আমার জন্য একমাত্র রাজনৈতিক আদর্শ, অনুভব ও অনুপ্রেরণা। 


সম্প্রতি তিনি আল্লাহ তায়ালার ৯৯ নামের প্রতি মানুষের কল্যাণময় সম্পর্কের খাতিরে ‘মৈত্রেয়’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। যার সকল বিক্রিকৃত সকল অর্থ তিনি করোনাকালিন কর্মহীন গরীব অসহায় মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন, এখনও করছেন। যতদিন করোনা মহামারি থাকবে ততদিন এ কল্যাণময় কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি। সম্ভবত আল্লাহ তায়ালার ৯৯ নাম নিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম কোন কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। 
মোস্তফা ইকবাল মনে করেন, পরমাত্মার সঙ্গে মানবাত্মার যে অবিনাশী সম্পর্ক, তা বিশ্বাস ও প্রেমের। এই মহাজগতে অতিক্ষুদ্র মানুষ কিভাবে কায়া ও ছায়াহীন মহান স্রষ্টার পরিচয় লাভ করবে? অথচ তাঁর পরিচয় লাভ, তাঁর স্মরণ ও তাঁর ইবাদত-আনুগত্য অপরিহার্য। মহান স্রষ্টা আল্লাহর পূর্ণ পরিচয় মানবসাধ্যের বহু ঊর্ধ্বে। মানুষ শুধু তার চেষ্টাটুকুই করতে পারে।
মানবজাতিকে বিশ্বাস ও প্রেম নিবেদন, প্রার্থনা ও আত্মসমর্পণের সুযোগ দিতে আল্লাহ প্রকাশ করেছেন তাঁর কিছু গুণবাচক নাম। হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী এর সংখ্যা ৯৯টি। তবে সব গুণের আধার মহান স্রষ্টার পরিচয় যে কোনো সংখ্যায় আবদ্ধ নয়, তা সহজেই অনুমেয়। কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর আছে সুন্দর সুন্দর নাম। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামে ডাকো। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৮০)
ভালোবাসা যখন বিশ্বাসদীপ্ত হয় বা বিশ্বাসে যুক্ত হয় প্রেমের জ্যোতি, তখন তাতে আসে গতি, তা হয়ে ওঠে ছন্দোময়। বিশেষত প্রেম নিবেদক যদি কবি হন, তখন আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসায় জ্যোর্তিময় হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা ও কাব্য। ‘মৈত্রেয়’ আল্লাহ-প্রেমে নিবেদিত তেমন একটি কাব্য সাধনা, ছন্দে-কাব্যে আল্লাহর গুণবাচক নামের মহিমা তুলে ধরার প্রয়াস, সর্বোপরি মহান স্রষ্টার সমীপে আত্মনিবেদন। কবি মোস্তফা ইকবাল নিজেই বলেছেন, ‘অসীম জ্যোতির ভেতরে এ কবিতাগুলো আল্লাহর সকাশে আত্মসমর্পণও বলা যায়। এর অক্ষর, শব্দ, ছন্দ, অন্ত্যমিল, উৎপ্রক্ষা, উপমা, পঙক্তির যে আবেগ, তা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অনুরণন ঢের; কাব্যিক মর্মে আমার প্রেম ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। 
আল্লাহর গুণবাচক ৯৯ নাম উপজীব্য করে লেখা কাব্যের শুরুতে কবি যুক্ত করেছেন ‘আল্লাহ’ নামক একটি দীর্ঘ কবিতা। করোনা মহামারির রমজানে লেখা এ কবিতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে কবির আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনা ও মুক্তির বিনীত প্রার্থনা, ভাষা পেয়েছে যাপিত জীবন ও অন্তহীন অপার্থিব জীবন নিয়ে কবির আত্মোপলব্ধি। 
ধ্যানস্থ কবি বলেন, 
‘তাঁরই সৃষ্টির অমেয় মর্মস্থলে লৌকিক ও অলৌকিক
অনুরণন শৈল্পিক খেলা পূর্ণতা সকল
সে প্রেমের আবর্তনে মানবজীবন-অবনী যাপন। ’
এ মৈত্রেয় বইয়ে আল্লাহর ৯৯ নামের আরবি-বাংলা উচ্চারণের পর কবি শাব্দিক অর্থ যোগ করেছেন। অতঃপর নিজস্ব উপলব্ধি থেকে ছন্দে-কাব্যে লিখেছেন তার মর্মকথা। শাশ্বত অর্থ-মর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রেমাবেগ, লেগেছে সময় ও বাস্তবতার ছোঁয়া। যেমন, ‘মুকিত’ (অন্নদাতা) আল্লাহর একটি গুনবাচক নাম। 
কাব্যানুবাদে কবি লিখেছেন, 
‘নিশ্চয়ই খাদ্য আয়োজন আপনার
আপনিই অন্নদানকারী, সৃষ্টি ও বরাদ্দে স্নিগ্ধ আন্তরিক
মানুষের দোষে লোভে কাড়াকাড়ি বৈষম্য প্রাচীর
সে হিসাব হবে কড়ায়-গণ্ডায় দুনিয়ার চতুর্দিক।’ 


চমৎকার অঙ্গসজ্জা ও রুচিশীল প্রচ্ছদের কাব্যগ্রন্থটির মূল্য ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা নিবেদন করা হয়েছে করোনাকালীন কর্মহীন মানুষের সাহায্যার্থে। তিনি জানান মৈত্রেয় কাব্যগ্রন্থের জন্য তার কাছে এখনও কিছু অর্থ সঞ্চিত আছে, যা দিয়ে ধারাবাহিক মুদ্রণের মাধ্যমে তিনি বইয়ের বিক্রয় মূল্য কর্মহীন মানুষের কল্যাণে ব্যয় করবেন। 
মোস্তফা ইকবাল এমন এক সহনশীল ব্যক্তিত্ব যিনি কখনো কোন অপশক্তির সঙ্গে আপোক করেননি। শুধু কবিতা লেখার জন্যই নয়, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হয়েও তিনি একাধিকবার করা বরণ করেছেন। তবুও তার রাজনৈতিক কোন উচ্চ বিলাসী চাহিদা বশবর্তী না হয়ে তিনি সর্বদা সাদাসিদা জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সুতরাং রাজনীতি ও কবিতা উভয়মুখী কর্মের জন্যই তার অসামান্য ত্যাগ রয়েছে। 


পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ