সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায়ও অদ্যম্য উদ্যোক্তা রেহানা আক্তার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট থেকে জাতীয় এসএমই পণ্য মেলার পদক গ্রহণ করছেন রেহানা আক্তার

ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায়ও অদ্যম্য উদ্যোক্তা রেহানা আক্তার

প্রকাশের সময় : April 24, 2022 | গণযোগাযোগ ও গণতন্ত্র

রেহানা আক্তার একজন স্বপ্নবাজ নারী উদ্যোক্তা। তিনি দেশের একমাত্র হাতে হ্যান্ডমেইক সিরামিক কারখানা ‘ক্লে ইমেজের কর্ণধার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে সিরামিকে অনার্স ও মাস্টার্স করেন তিনি। চাকরি না করে আজ তিনি সফল নারী উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পে তিনি বলেন, পড়াশোনার জন্য কাজ করতে করতে এ খাতের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। শুরুতে একটি প্রদর্শনীতে তার আঁকা সিরামিক পণ্য বেশ ভালো সাড়া পায়। ক্রেতাদের উৎসাহ দেখে এমন উদ্যোগ শুরু করতে উদ্বুদ্ধ হন সিরামিকে স্বপ্ন আঁকা এ নারী উদ্যোক্তা। নিজে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও ভৌগলিক ও প্রকৃতিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আপন স্বপ্ন তিল তিল করে বাস্তবে রূপান্তর করেছেন অদম্য উদ্যোক্তা রেহানা। বিলাশবহুল পরিবারের সান্নিধ্য ত্যাগ করে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই তিনি বিভোর হয়েছিলেন। 


নিজস্ব চুল্লি না থাকায় নারায়ণগঞ্জ ও রায়েরবাজারে অন্য কারখানার চুল্লিতে পুড়িয়ে পণ্য তৈরি করে বিক্রি করতেন। পরে ভালো সাড়া পাওয়ায় চুল্লি ও দক্ষ শ্রমিক নিয়ে নিজের কারখানা করতে ১০ লাখ টাকা পুঁজি পান পরিবারের কাছে থেকে। এখন মিরপুর ও ধানমন্ডিতে শোরুম রয়েছে তার। ৭০ কর্মীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় করার স্বপ্ন দেখছেন সিরামিককে ভালোবেসে ফেলা এ উদ্যোক্তা।
সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে এবার এসএমই ফাউন্ডেশনের বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ২০২০ পুরস্কার পেয়েছেন। গত বুধবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় এসএমই মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন ক্লে ইমেজ নামের সিরামিকের পণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা রেহানা আক্তার।
এসএমই মেলায় নিজের স্টলে রং বেরঙের সিরামিক পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। স্টলে বসেই উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনান তরুণ এ উদ্যোক্তা। ছাত্রাবস্থায় সিরামিকের কারুকাজে প্রতিবছর সেরা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছি। সেটিও প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে নিজের কিছু করার ক্ষেত্রে। বর্ষসেরা উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়ে রেহানা বলেন, ২০০২ সালে পড়াশোনা শেষে নিজের উদ্ভাবন কাজে লাগাতে ভিন্ন কিছু করার চিন্তা ছিল। ওই সময় মুন্নু সিরামিক থেকে একটি চাকরির অফার পেয়েছি। তখন বাবার সঙ্গে আলাপ করলে তিনি চাকরির বদলে নিজে কিছু করার পরামর্শ দেন। সেই ভাবনা থেকে তার সহযোগিতায় রাজধানীর মিরপুরে নিজেদের বাসার চিলেকোঠায় শুরু হয় সিরামিক পণ্য তৈরি। শুরু হয় ছোট পরিসরে ক্লে ইমেজ নামের ব্যবসার পথচলা।
আকাশচুম্ভী স্বপ্নের সারথী রেহানা বলেন স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। তাই উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তিও হয়েছিলাম। পরিবারের প্রায় সদস্যই যেহেতু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর করপোরেট কোম্পানির চাকরিজীবী, সেখানে এমন স্বপ্নের বাইরে অন্য কিছু করার বা পেশা হিসেবে গ্রহণ করার কথা চিন্তাই করতে পারিনি। কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুরে হিসাব পাল্টে গেল জীবনের। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরের বছর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সিরামিকস বিভাগে ভর্তির সুযোগ হয়। এই সুযোগ লুফে নিয়ে ভর্তিও হয়ে যাই চারুকলার সিরামিকস বিভাগে। সেই তো স্বপ্নের পথচলা শুরু। সেই পথচলায় শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে আমি।
একজন সাধারণ মানুষ থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার অসাধারণ গল্প বলছিলেন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত এসএমইর বর্ষসেরা নারী উদ্যোক্তা ক্লে ইমেজের স্বত্বাধিকারী রেহানা আক্তার। গল্পে গল্পে রেহানা আরও বললেন, চারুকলায় ভর্তির প্রথম বছরেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিজের সৃজনশীল প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার জিতে নেন তিনি।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনেকটা মানসিক আভিজাত্য থেকেই সিরামিকস বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।
সেই শখই আজ স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার। সিরামিকস পণ্যের ক্যানভাসে সমৃদ্ধির স্বপ্ন আঁকেন তিনি। আপন আলোয় একক প্রচেষ্টায় আর কঠোর পরিশ্রমে রেহানা আক্তার এখন চাকরি করেন না বরং তার প্রতিষ্ঠিত ক্লে ইমেজে ৭০ জন কর্মী কাজ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। সিরামিকস পণ্য তৈরির পর তুলির আপন ধারায় রাঙিয়ে তোলেন জীবন-জীবিকার ক্যানভাসে। কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা। যতদিন বাঁচবেন এই সিরামিকস নিয়েই স্বপ্ন তার।


রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের প্রাঙ্গণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অষ্টম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলার বিশাল আয়োজনে এমন অসংখ্য উদ্যোক্তা ক্ষুদ্র পরিসরে উৎপাদিত তাদের পণ্যের বিপুল সমাহার ঘটিয়েছেন।
মেলায় দেশে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য, খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, আইটি পণ্য, প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্য, হস্তশিল্প, ডিজাইন ও ফ্যাশনওয়্যারসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের স্বদেশি পণ্য প্রদর্শিত ও বিক্রি হচ্ছে। আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা একটু সহযোগিতা এবং সুযোগ পেলে কত কিছু করতে পারে, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যাবে এসএমইর এই পণ্য মেলায়। সরেজমিন মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেল, বেশ গোছাল পরিবেশে এসএমই মেলায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের দেশীয় পণ্য মিলছে। 
হল ডি-তে ২৫২ নাম্বার স্টলে সুপারির আঁশের তৈরি সুদৃশ্য পেইন্টেড ওয়ান টাইম বাটি, প্লেট, কলমদানি, ঘর সাজানোর বাহারি রঙের শোপিসসহ বিভিন্ন জিনিসের সমাহার দেখতে উপচে পড়া ভিড় ছিল সাধারণ মানুষের।  শুধু সুপারির আঁশ দিয়েই নয় বরং আনারসের পাতার আঁশ এবং কলাগাছের আঁশের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের দেখাও মিলছে অরগাসাস নামের প্রতিষ্ঠানের এই স্টলে। স্টলের কর্তাব্যক্তিরা বললেন, পরিবেশ বিধ্বংসী প্লাস্টিক থেকে আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতেই এই প্রচেষ্টা। সরকারি সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সামনের দিনগুলোতে আমরা আরও ভালো ভালো কিছু করতে পারব বলে আশা করছি।
এ ছাড়াও এসএমই ফাউন্ডেশনের পণ্য মেলায় কারুকাজ করা প্লক বাটিকের রঙিন পোশাক, নকশিকাঁথা, চামড়ার মানিব্যাগ, চামড়ার মোবাইল ব্যাগ, চামড়ার পার্টস, বেল্ট, ফুটওয়্যার পণ্য, বেকারি, ফাস্ট ফুড, অরগানিক খাদ্য, সরিষা ও কালিজিরা তেল, মধু, আচার, হরেকরকম টকঝাল চাটনি এবং হ্যান্ডিক্রাফট ও হস্তশিল্পে কারুকাজ করা বহু পণ্যের বিপুল আয়োজন তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে জামদানি শাড়ি, থ্রিপিস, টুপিস, শাল, বিভিন্ন পাটজাত পণ্য, পাটের ব্যাগ, চামড়াজাত সামগ্রী, হাতে ভাজা মুড়ি, ঢেঁকিছাঁটা চাল, খৈ, মধু, পোশাক, হারবাল পণ্য এবং আইটি পণ্য সামগ্রীসহ দেশীয় উদ্যোক্তাদের তৈরি কৃষিপণ্য। আর ক্রেতাদের আগ্রহের কথা চিন্তা করে শুধু পোশাকেই সীমাবদ্ধ নেই আয়োজন। এর সঙ্গে মিল রেখে ব্যাগ, গহনাসহ হাতব্যাগও পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। মেলায় ঘুরতে আসা ক্রেতা দর্শনার্থীরাও ছিল বেশ উচ্ছ্বসিত।  এক দশনার্থী বললেন, দেশীয় উদ্যোক্তাদের তৈরি এতসব পণ্য দেখে সত্যিই আমি অভিভূত। সার্বিকভাবে পণ্যের গুণগত মান উন্নত এবং দামও হাতের নাগালের মধ্যেই হওয়ায় বেশ কিছু কেনাকাটা করলাম। 
রেহানা মনে করেন উদ্দেশ্য সৎ ও মানসিকভাবে অদম্য সাহস ও আপন স্বপ্নে বিভোর হলে স্বপ্ন একদিন পূর্ণতা লাভ করবেই। এতে দেশের উদ্যোক্তাদের শিক্ষা ও চিন্তাশীল পর্যবেক্ষণের কোন বিকল্প নেই।