শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
বীমা খাতে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নীতি ও এর প্রয়োগ করার প্রক্রিয়া
নূরে আলম সিদ্দিকী অভি, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা: আলফা ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স লিমিটেড 

বীমা খাতে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নীতি ও এর প্রয়োগ করার প্রক্রিয়া

প্রকাশের সময় : September 22, 2022 | বীমা

নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বীমা খাতে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তরুণ পেশাজীবী ব্যক্তিত্ব । তিনি আলফা ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অভি ১৯৭৩ সালের পহেলা জুন ফেনীর একটি স্বনামধন্য মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং পরবর্তীতে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় থাকাকালীন ২০০০ সালে গবঃখরভব (অষরপড়) এর সঙ্গে তার বীমা কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১৪ সালে তিনি চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান বিক্রয় ও বিপণন হিসাবে যোগদান করেন এবং ২০১৫ সালে তিনি সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান বিক্রয় ও বিপণন হিসাবে যোগদান করেন। অভি বাংলাদেশ বীমা শিল্পে ৩-লেয়ার সিস্টেমের (এফএ) উদ্ভাবক। তিনি অ্যালিকোয় কাজ করার সময় তার পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে সারা বিশ্বের মধ্যে ১ম অবস্থান (ঋঅ. টগ ্ ইগ) অর্জন করেন। অভি এ পর্যন্ত ৪৮টি দেশে ভ্রমণ করেছেন। এরমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রেঞ্চ, স্পেন, চীন, জাপান এবং সিঙ্গাপুর ইত্যাদি অন্যতম। ২০২০ সালের ২৬ শে জানুয়ারী তিনি অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডে যোগদান করেন। তার কর্ম দক্ষতার জন্য কোম্পানি তাকে ২০২০ সালে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ইনচার্জ) অফার করে। এর পর থেকেই তিনি কোম্পানির আর্থিক উন্নয়ন এবং সুনাম বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছেন।  সম্প্রতি ৩য় বীমা দিবসে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে তিনি প্রতিষিদ্ধের সঙ্গে কথা বলেন নূরে আলম সিদ্দিকী অভি। 


নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বলেন, আমি মনে করি দিবসটা বীমা শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই করোনার মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বীমা দিবসে সরকারি-বেসরকারি অংশীজনরা এতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করবেন। ১ মার্চ ৭৯টি বীমা কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের নিজস্ব উদ্যোগে শোভাযাত্রা বের করেছেন। অফিসগুলোয় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া প্রচারণার অংশ হিসেবে ট্রাক সুসজ্জিত করে শহরে প্রদক্ষিণ করা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে বীমা সম্পর্কে মানুষের যে আস্থার সংকট, সেটা অনেকাংশে দূর হবে বলে আমি আশাবাদী।
নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বলেন, বীমা দাবি পরিশোধ করাটা আলফা ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের জন্য একটি যুগান্তকারী বিষয়। ২০২০ সালের প্রথম থেকে কয়েক মাস বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব যখন ছিল করোনায় জর্জরিত, লকডাউনে সব ধরনের অফিস-আদালত বন্ধ ছিল, গাড়ির চাকাও ঘোরেনি, সে সময় আমরা গ্রাহকদের যথাযোগ্য সেবা দিতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু কোম্পানির দাবি পূরণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভালো কোম্পানিগুলোকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। তাই আমি বলব সরকার ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে আরো কঠোর নজরদারি করে এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। 
বীমা শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে জানতে চাইলে নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বলেন, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ধাপে ধাপে বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫টি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। এরমধ্যে ৩৫টি হলো জীবন বীমা কোম্পানি। এসব লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে একটি মার্কেট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা, মাথাপিছু আয় ও শিক্ষার হার বেড়েছে। এজন্য আমি মনে করি, বীমা খাতের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে।

এখন পর্যন্ত বীমা শিল্পে কী ধরণের অগ্রগতি হয়েছে জানতে চাইলে নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বলেন বলেন, বীমার অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এখনো সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি। তবে বর্তমান সরকারের যে বিভিন্ন উদ্যোগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও আইডিআরের (বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ) সমন্বয়ে প্রবাসীদের জন্য বীমা, শস্য বীমা, কৃষি বীমা, প্রতিবন্ধীদের জন্য বীমা বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা এবং সর্বোপরি ব্যাংক ইন্টারেস্টসহ গৃহীত উদ্যোগ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে আশা করছি বীমা শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
বীমা খাতের অগ্রগতির জন্য কোন দিকটিতে নজরদারি দরকার জানতে চাইলে নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বলেন, বিগত দিনে বীমা খাত পিছিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এক কোম্পানির দক্ষ কর্মীকে ছাড়পত্র ছাড়াই আরেক কোম্পানি বড় অফার দিয়ে নিয়ে যেত। এমনকি এক কোম্পানিতে দুর্নীতি করার পরও অন্য কোম্পানির বিশাল বিশাল দায়িত্বে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া কিছু কোম্পানি ১০০ টাকা প্রিমিয়াম আনতে গিয়ে ১৫০ টাকা খরচ করেছে। যেকোনো লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রথম ১০ থেকে ১২ বছর প্রিমিয়াম গ্রহকদের কাছ থেকে নিয়ে আসে। সুতরাং অন্তত ১০ বছর আগে তার টাকা ফেরত দেয়া লাগছে না। ওই কোম্পানিগুলো যদি মনে করে, ১০ বছরে যা প্রিমিয়াম পেয়েছি, সব আমার টাকা, তারা যদি অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় করে ফেলে, সে কোম্পানি মেয়াদ শেষে গ্রাহকের দাবি কীভাবে পরিশোধ করবে! এ ধরনের কিছু কোম্পানির কারণে বাজারে কিছুটা অস্থিতিশীলতা রয়েছে। যেসব কোম্পানি বর্তমান দাবি পরিশোধে দীর্ঘসূত্রতা করছে, তাদের কঠোর হাতে নজরদারি করতে হবে। এজন্য সরকার ও আইডিআরকে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।
দেশের বীমাখাতের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বলেন বলেন, বর্তমানে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নীতি ও এর প্রয়োগ বা নীতি বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া। উন্নত দেশগুলোতে বীমা বাধ্যতামূলক। উন্নত বিশ্বে বীমাকে অন্যান্য মৌলিক চাহিদার মত সমান গুরুত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে বীমা বাধ্যতামূলক না হওয়ার কারণে কেউ স্বেচ্ছায় বীমা করতে আগ্রহী হয় না। সুতরাং আমাদের একটি নীতি থাকতে হবে। বীমাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিদেশগামী কর্মীদের বীমা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে সরকার, অথচ দেশত্যাগের আগে প্রবাসগামীর বীমা আছে কী না তা কর্তৃপক্ষ যাচাই করছে না। একটি প্রতিষ্ঠানে ৫০ জনের অধিক কর্মী হলে বীমা বাধ্যতামূলক। এজন্যই নীতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি একটি চ্যালেঞ্জ। দেশের পোশাকশিল্প খাতে ৪২ লাখের মতো কর্মী রয়েছে। সরকার তাদের জন্য বীমা বাধ্যতামূলক করলে এক নীতিতেই এই ৪২ লাখ ব্যক্তি বীমার আওতায় চলে আসে। ১৪ লাখ সরকারি কর্মী রয়েছে। তাদের জন্যও বীমা বাধ্যতামূলক করা উচিত। যদি সব শিল্প কারখানা কর্তৃপক্ষকে বলা হতো কর্মীদের বীমা না করলে লাইসেন্স বাতিল, তাহলে তারা বীমা করতে বাধ্য হতেন। ফলে জিডিপিতে বীমার প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবতে হতো না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বীমা খাতের চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে বীমা কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র ক্যাপটিভ এজেন্সি এবং কমিশন সেলস মডেলের উপর নির্ভরশীল। 


নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বলেন বলেন, এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণে ক্যাপটিভ মডেলের সাথে সাথে অন্যান্য ডিস্ট্রিবিউশন মডেল চালু করতে হবে। প্রোডাক্ট পরিকল্পনা ও পদ্ধতি সহজতর করতে হবে। ব্র্যান্ড ভ্যালু, বীমা সেবার পরিমাণ এবং গুণগতমানসহ সকল দিকে খেয়াল রাখতে হবে। গ্রাহকদের একাধিক ধরনের বীমা নিরাপত্তা প্রদান করা। নতুন নতুন প্রোডাক্ট উদ্ভাবন যেমন- জীবন, স্বাস্থ্য, দুর্ঘটনা, শস্য, গবাদিপশু, ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয়ে নতুন পরিকল্পের মাধ্যমে বীমা সেবার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। উপযুক্ত পেমেন্ট ম্যাকানিজমের সাথে আপসেল করা। বীমা খাতে ইমেজ ফেরাতে আমরা যথাসময়ে গ্রাহককে তার প্রাপ্য টাকা ফেরত দিচ্ছি। সব ধরনের সেবা ডিজিটালাইজড করেছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করছি।

বাংলাদেশে স্বচ্ছ কর্পোরেট গভার্নেন্স সম্পর্কে জানতে চাইলে নূরে আলম সিদ্দিকী অভি বলেন বলেন, বাংলাদেশে করপোরেট গভর্ন্যান্স আলোচনায় নিয়ে আসতে এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট গুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন পরে গেজেটের মাধ্যেমে ‘করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড’ চালু করে (দেখুন আগস্ট ৭, ২০১২ এবং তার পরবর্তী প্রাসঙ্গিক নোটিফিকেশনগুলো)। এখানে পশ্চিমা আদলে সুশাসনের বিভিন্ন ধারা আছে: বোর্ড অব ডিরেক্টর কয়জন হবে, কারা হবে (যেমন ন্যূনতম এক অংশ হবে ইনডিপেনডেন্ট), ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টরের যোগ্যতা, বোর্ডের প্রধান ও সিইও আলাদা ব্যক্তি হবে, বোর্ড অব ডিরেক্টরের শেয়ারহোল্ডারদের কাছে কী রিপোর্ট দেবেন, বোর্ড বছরে কয় দিন মিটিং করবে, অডিট কমিটির কী গুরুত্ব ইত্যাদি। এসব ইতিবাচক পদক্ষেপ। অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দেশে এসব করপোরেট গভর্ন্যান্স কোডের সঙ্গে কোম্পানির আয় ও শেয়ারের মূল্যমানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পাওয়া যায়। তাছাড়া করপোরেট মুনাফার রিপোর্টে বিভিন্ন লুকাছাপা (যেমন আর্নিংস ম্যানেজমেন্ট বা লাভ-লোকসানের খতিয়ানে অপকৌশল) কমে আসার প্রমাণ মিলে। তো অনেকাংশে বলতে পারেন বারলে, মিন্স, কোজ, জেন্সেন, মেকলিং যে ম্যানেজারদের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিপরীতে পুঁজির ব্যবহার, বণ্টন, বিনিয়োগ নিয়ে আশঙ্কা করেছিলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্সের কোড বা তার কিছু অংশ তা কমায়। তবে আলোচনা এই জায়গায় থেমে থাকলে করপোরেট পুঁজির অপব্যবহার রোধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, যেসব উন্নয়নশীল দেশ আমেরিকা, ইউরোপের অনুসরণে করপোরেট সুশাসনের ধারণা ও তত্ত্বের ভিত্তিতে করপোরেট সুশাসন চালু করেছে, তাদের কিছু গোড়ার কথা, মৌলিক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে; আবার নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও ভুললে চলবে না। তত্ত্বকে আমাদের পরিচালিত করতে না দিয়ে, বরং আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী তত্ত্বকে কাজে লাগাতে হবে।