ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের কোল্ড স্টোরেজ মর্গ এক্সটেনশন থেকে একে একে বের করা হচ্ছে মরদেহ। এসব মরদেহ যখন বের করা হচ্ছিল বাতাশে তখন তীব্র গন্ধ, যা উপস্থিত সবার অপরিচিত। কারও মুখে মাস্ক, কেউ আবার নাক-মুখ ঢেকে রাখেন। ৭ আগস্টের তখন দুপুর সাড়ে ১২টা।
মরদেহগুলোর চেহারা বিকৃত অবস্থায়, কাউকে চেনার মতো নেই। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো যে ছয়জনের পরিচয় এক বছরেও শনাক্ত করা যায়নি, তাদের মরদেহ মর্গ থেকে বের করা হয় এদিন। এরপর দাফনের জন্য দেওয়া হয় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে।
এসব মরদেহ গত এক বছর ঢামেক হাসপাতালের মর্গে পড়ে ছিল। এই দীর্ঘ সময়েও তাদের খোঁজে আসেনি কেউ। অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবেই মরদেহগুলো দাফন করা হয় জুরাইন কবরস্থানে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মরদেহগুলোর মধ্যে একজন নারী, আনুমানিক বয়স ৩২ বছর। বাকিগুলো পুরুষের। তাদের বয়স ৩০, ২৫, ২০, ২২ ও ২৫ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কোনো মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়। এরপর নিহতের আত্মীয়ের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো এই ছয়জনের ভাগ্যে শেষ বেলায় স্বজনের ছোঁয়াও মেলেনি। জানাজার পর আঞ্জুমান মুফিদুল তাদের দাফনের ব্যবস্থা করে। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হলেও কবরে চিহ্ন রাখা হয়েছে। যদি নিহতের কোনো নিকটাত্মীয় মরদেহের দাবিদার হয় তখন ডিএনএ স্যাম্পল মিলিয়ে হস্তান্তর করা হবে। ছয়টি মরদেহের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা রয়েছে।
বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হলেও কবরে চিহ্ন রাখা হয়েছে। যদি নিহতের কোনো নিকটাত্মীয় মরদেহের দাবিদার হয় তখন ডিএনএ স্যাম্পল মিলিয়ে হস্তান্তর করা হবে। ছয়টি মরদেহের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা রয়েছে।
পুলিশ বলছে, বেওয়ারিশ মরদেহ পেলে প্রথমে ময়নাতদন্ত হয়, পরিচয় জানার জন্য থাম্ব ইম্প্রেশন (আঙুলের ছাপ) থেকে এনআইডির সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করা হয়। এভাবে প্রাথমিকভাবে যদি পরিচয় শনাক্ত না হয় সেক্ষেত্রে ডিএনএ নমুনা নিয়ে সিআইডিকে পাঠানো হয়। এছাড়া মামলা দায়ের করে দেশের সব থানার ইউনিট গুলোকে জানানো হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ জানায়, যদি কোনো মৃত ব্যক্তির হাতের আঙুলের ছাপ অস্পষ্ট থাকে সেক্ষেত্রে তার পরিচয় জানা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তখন নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে ডিএনএ স্যাম্পল মেলানো ছাড়া আর উপার থাকে না। এই ছয় মরদেহের ক্ষেত্রে সবার আঙুলের ছাপ অস্পষ্ট ছিল। তাদের কারও পরিবার মরদেহ নিতে আসেনি। এ কারণে ভবিষ্যতের জন্য ডিএনএ স্যাম্পল রেখে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী গোলাম মুখলেসুর রহমান বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে এক বছর আগেই আমরা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করি, কিন্তু মরদেহগুলো আনআইডেন্টিফাই ছিল। এ কারণে পুলিশ সেগুলো আমাদের মর্গে রেখেছিল। পুলিশের মাধ্যমেই এসব মরদেহ আঞ্জুমানের কাছে হস্তান্তর করা হয় দাফনের জন্য। এ ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে ভোতা কোনো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়। আরেকজনকে গুলি করে মারা হয়।
ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) ফারুক আহমেদ বলেন, এসব মরদেহের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। আদালতের শরণাপন্ন হয়ে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে মরদেহগুলো দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সব মরদেহের সিরিয়াল নম্বর দেওয়া রয়েছে। ভবিষ্যতে কেউ দাবি করলে ডিএনএ স্যাম্পল মিলিয়ে হস্তান্তর করা হবে। দীর্ঘদির হয়ে যাওয়ায় এসব মরদেহের আঙুলের ছাপ অস্পষ্ট। এ কারণে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলেনি।
৫ অগাস্টের আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীসহ কয়েক এলাকা থেকে এসব আসে এসব মরদেহ। ময়নাতদন্ত অনুযায়ী, তাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে আঘাতজনিত কারণে।
ছয়জনের মরদেহের বিষয়ে মামলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যেহেতু কোনো পরিবার দাবি করেনি, সেহেতু মামলা হয়নি। তবে পুলিশ ইডি মামলা করেছে। তদন্ত সাপেক্ষে যদি মনে হয় হত্যাকাণ্ড তবে পরবর্তী সময়ে হত্যা মামলা করা হবে।
শাহবাগ থানা পুলিশ জানায়, ৫ অগাস্টের আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীসহ কয়েক এলাকা থেকে এসব আসে এসব মরদেহ। ময়নাতদন্ত অনুযায়ী, তাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে আঘাতজনিত কারণে।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ঘিরে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে শহীদের সংখ্যা বলা হয়েছে প্রায় ১৪০০ জন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে গেজেট তৈরি করেছে, তাতে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ৮৪৪ জনের নাম রয়েছে।