ফ্লোটিলা সুমুদ: মানবতার নৌবহর ও নীরব বিশ্বের বিবেক

ওমর ফারুক

সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা এক নৌবহর ‘গ্লোবাল ফ্লোটিলা সুমুদ’, কোনো রাষ্ট্রের নয়, কোনো ধর্মের নয়, কোনো গোষ্ঠীর নয় এটি মানবতার বহর। চিকিৎসক, শ্রমিক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, নারী ও তরুণ—সবাই এতে আছে, শুধু একটিমাত্র উদ্দেশ্যে: গাজার মানুষের কাছে পৌঁছানো, জীবন বাঁচানো।

‘সুমুদ’—আরবি শব্দ, যার অর্থ দৃঢ়তা ও প্রতিরোধ। এই ফ্লোটিলা সেই দৃঢ়তার নাম, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়: মানবতা কখনো ধর্ম, জাতি বা ভূরাজনীতির সীমায় আটকে থাকে না।

গাজার অবরুদ্ধ উপকূলে এই বহরের আটকে পড়া কোনো কূটনৈতিক ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এটি বিশ্ব বিবেকের ওপর এক আঘাত। ইসরায়েলের অবরোধে আজ গাজা এক মানবিক কারাগার খাদ্য, পানি, ওষুধ, জ্বালানি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। শিশুদের পুষ্টিহীন দেহ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হাসপাতাল, এবং দীর্ঘ সারিতে কবর খোঁড়া এই হচ্ছে ২১শ শতকের এক বাস্তব চিত্র।

এই প্রেক্ষাপটে, যখন রাষ্ট্রগুলো নীরব থাকে, তখন ফ্লোটিলা সুমুদ কথা বলে। এটি কোনো অস্ত্রবাহী যুদ্ধবহর নয়, বরং মানবতার এক চলমান ঘোষণা: “যেখানে অবরোধ, সেখানেই আমরা প্রতিরোধ।”

গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক বিপর্যয় এখন আর শুধু সহানুভূতি দাবি করছে না; এটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও মুসলিম বিশ্বে, গাজার সংকটকে ধর্মীয় বা জাতিগত দ্বন্দ্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেন এটি দুটি সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন: এটি কোনো ধর্মীয় যুদ্ধ নয়, বরং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

ইসরায়েলের অবরোধ ও হামলা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ। জাতিসংঘের চার্টার, জেনেভা কনভেনশন, এবং সাগরপথে স্বাধীন চলাচল নিশ্চিতকারী UNCLOS সবকিছুকেই এই আক্রমণ অমান্য করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস কালামার্ড বলেছেন, “উন্মুক্ত সাগরে শান্তিপূর্ণ মানবিক জাহাজ আটকানো কেবল আইনবিরুদ্ধই নয়, এটি মানবতার প্রতি সরাসরি অবজ্ঞা।”
জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ একে বলেছেন “অবৈধ অপহরণ”, এবং উল্লেখ করেছেন যে গাজার মানুষ এখন “ইসরায়েলের খুনক্ষেত্রে” আটকে পড়েছে।

বাংলাদেশসহ বহু দেশে গাজার প্রতি সংহতি প্রকাশের আন্দোলনগুলো প্রায়ই ধর্মীয় আবেগের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে। এতে মানবিক সংহতির স্বর থাকলেও, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের দিকগুলো অনেক সময় আড়ালে পড়ে যায়। এমন অবস্থায় সংকটের প্রকৃত চরিত্র—অবরোধ, দুর্ভিক্ষ, ও গণহত্যার মতো বিষয়—ছায়ায় ঢেকে যায়।

গাজার সংকটকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সহমর্মিতা সীমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু যখন আমরা এটিকে মানবাধিকারের লেন্সে দেখি, তখন এটি হয়ে ওঠে এক সার্বজনীন ন্যায়ের আন্দোলন যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, নাস্তিক সবাই একই পাশে দাঁড়াতে পারেন, কারণ অন্যায় কেবল এক জাতির নয়, এটি সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ (GSF) গঠিত হয়েছে অন্তত ৪৪টি দেশের প্রতিনিধি দল নিয়ে—যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক, সুইডেন, স্পেন, মালয়েশিয়া ও কলম্বিয়া। এই বহরে মানবাধিকারকর্মী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সংসদ সদস্য, শ্রমিক, এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের নেতারাও রয়েছেন। তাদের ঐক্য প্রমাণ করে: গাজার জন্য লড়াই কোনো ধর্মীয় আনুগত্য নয়, এটি বিবেকের ডাক।

ইতালিতে ফ্লোটিলা আটকানোর পর দেশের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো দেশব্যাপী ধর্মঘট ঘোষণা করে। দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ রাস্তায় নামে “Free Palestine, Stop the war machine!” স্লোগানে। এ আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নয়, এটি জনগণের মানবিক নৈতিক প্রতিক্রিয়া। একই সঙ্গে তুরস্ক, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে একটি বৈশ্বিক সংহতির অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৭২০ ও ২৭২৮ নং প্রস্তাব মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবাহের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু ইসরায়েল সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে ফ্লোটিলা আটক করেছে যা চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের সমান।

আইটিএফ-এর মহাসচিব স্টিফেন কটন বলেছেন, “মানবিক জাহাজে আক্রমণ করা মানে আন্তর্জাতিক আইনের পবিত্র নীতিগুলোর ওপর আঘাত।”

গাজায় দুর্ভিক্ষ এখন এক গণহত্যার রূপ নিয়েছে খাদ্য ও পানি সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, ফ্লোটিলার মানবিক যাত্রা শুধু একটি প্রতিবাদ নয়, এটি আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে এক নৈতিক অবস্থান।

বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই নৌবহর আটকানোর ঘটনাকে “আন্তর্জাতিক আইনের শীর্ষ লঙ্ঘন” বলে নিন্দা জানিয়েছে এবং গাজার প্রতি মানবিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাগরিক সমাজ, শ্রমিক ইউনিয়ন ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রতিবাদগুলো ধর্মীয় নয়, বরং মানবতার পক্ষে এক নৈতিক ঐক্যের প্রকাশ।

পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ একে বলেছেন, “গাজায় ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে কেউ ন্যায়ের পক্ষে, তার নৈতিক বাধ্যবাধকতা হচ্ছে—Free Palestine।”
এমন বক্তব্য প্রমাণ করে, গাজার প্রশ্ন এখন ধর্মের নয়, বরং মানবতার টেস্ট কেস হয়ে উঠেছে।

যারা ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’-র জাহাজে পাড়ি জমিয়েছে, তারা জানত এটি বিপজ্জনক এক যাত্রা। ইসরায়েলি বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার, গ্রেপ্তার হওয়ার, এমনকি প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল। তবু তারা যাত্রা করেছে, কারণ তারা জানে, “নীরবতা কথা বলার চেয়েও ভয়ংকর।”

তারা তাদের উপস্থিতি দিয়ে প্রমাণ করেছে মানবতা কোনো সীমানায় আবদ্ধ নয়। যেখানে রাষ্ট্রগুলো চুপ থাকে, সেখানেই সাধারণ মানুষ উঠে দাঁড়ায়, এবং সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা সেই জাহাজগুলোই তখন পৃথিবীর বিবেক হয়ে ওঠে।

ফ্লোটিলা সুমুদ কেবল এক নৌবহর নয়; এটি প্রতিরোধের এক জীবন্ত উপাখ্যান,
যা ইতিহাসের পাতায় লিখে যাচ্ছে, মানবতা কখনও ডুবে না, যতক্ষণ মানুষ লড়তে জানে।

ওমর ফারুক
গণমাধ্যম কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *